কৃষিপণ্যের বিপণন তথা বাজারজাতকরণ হলে এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে উৎপাদিত কৃষিপণ্য উৎপাদনকারী কাছ থেকে চুড়ান্ত ভোক্তার কাছে পৌছায় এ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন কর্মস্তর অতিক্রম করতে হয়। উৎপাদন শেষে পণ্য সংগ্রহ ও একত্রকরণ পণ্যের শ্রেনী ও নমুনাকরণ, গুদামজাতকরণ পরিবহন, ঝুঁকি বহন, বিজ্ঞাপন প্রদান, বাজার সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহ, বণ্টন, বিক্রয় ইত্যাদি সুষ্ঠুভাবে সম্পাদিত হলে কৃষকরা পণ্যের উপযুক্ত দাম পায় এবং ভোক্তা সাধারণত তা যুক্তিসংগত দামে ক্রয় করতে পারে। বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ হলেও এখানে কৃষিপণ্যের বিপণন তথা বাজার ব্যবস্থা অনুন্নত, অসংগঠিত ও ত্রুটিপূর্ণ। আর্থিক অবস্থা দুর্বল থাকায় বেশিরভাগ কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য মৌসুমের শুরুতেই অত্যন্ত কম দামে গ্রামের হাট-বাজারে বিক্রি করে দেন। অনেক সময় ফসল ক্ষেতে থাকা অবস্থায় আগাম বিক্রি করা হয়। ফড়িয়ারা তা কিনে উপজেল সদর বন্দর ও ছোট শহর গুলোয় পাইকার, আড়তদার, মহাজন ইত্যাদি মধ্যসত্বভোগীদের কাছে কিছু লাভে বিক্রি করেন। গত বছরের শেষের দিকে লাভজনক ড্রাগন ফল চাষে বড় রকমের আঘাত আসে। ইউটিউব, ফেসবুকসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ড্রাগন নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা হয়। ফল বিক্রি নিয়ে বিপাকে পড়েন আড়ৎদার ও চাষীরা। অনেক চাষীর ফল ক্ষেতেই নষ্ট হয়। এছাড়া এ বছর কৃষি পন্য বয়কটের নতুন ট্রেন্ড যুক্ত হয়েছে। ফলে এবছর উৎপাদিত ফল বিক্রি ও বাজার কেমন যায় সেদিকে রয়েছেন উপজেলার কয়েকশত কৃষি উদ্যোক্তা। কথাগুলো বলছিলেন ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলার বানুড়িয়া গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা মিজানুর রহমান। উদ্যোক্তা মিজান বলেন, ‘আমাদের কিছু সংখ্যক ড্রাগন চাষী ছোট ফল বড় করতে গত দুই বছর ধরে ইন্ডিয়ান একটি টনিক ও পরবর্তীতে দেশীয় ভাবে তৈরী টনিক ব্যবহার করেন। এতে ফলের আকার ও ওজন বৃদ্ধি পেলেও স্বাদ ও রঙ নষ্ট হয়ে যায়। টনিক ব্যবহারে লাল কালারের ফলগুলো লাল-সবুজ ও হলদেটে কালারে পরিণত হয়। কিছু কিছু ফল উদ্ভট আকৃতির হয়। এ নিয়ে এক শ্রেণির ইউটিউবার ও ফেসবুকাররা ড্রাগন ফল নিয়ে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে ভিডিও কন্টেন্ট তৈরী করে। দুই একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় অন্যরাও ভিউ পেতে শত শত ভিডিও তৈরী করেন যার অধিকাংশই নেতিবাচক। যদিও কৃষি গবেষণা অধিদপ্তরের কর্তা ব্যাক্তিরা বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বিষয়টি স্পষ্ট করেন যে, নির্দিষ্ট মাত্রায় হরমোন ব্যবহার সারা বিশ্বেই স্বীকৃত। এছাড়া ওই সকল ফলের ল্যাবটেস্টেও ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তারপর ড্রাগনে ভোক্তা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। পাইকারী বাজারে বড় আকারের ফলগুলো বিক্রি করা যায়নি । যার কারণে এ বছর ফল বিক্রি বেশ বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তার চালিকাশক্তি হচ্ছে কৃষক, মৎস্যজীবী, গবাদি পশু-পাখির খামারী ও গৃহস্থ্য। বর্তমানে কৃষক, মৎস্যজীবী, গৃহস্থ্য ও খামারীদের অবমূল্যায়ন, দেশের কৃষিজমি ও কৃষি ভর্তুকির হ্রাসকরন, বীজের বাণিজ্যিকীকরণ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবসায়িদের আধিপত্য,কৃষিজাত,মৎস্য ও খামারীদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়ায় ফড়িয়া ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম,অপরিহায্য ফসলের পরিবর্তে অর্থকারী ও বাণিজ্যিক ফসলের অধিকতর চাষ,জলাভূমি অ-মৎস্যজীবীদের দখলে,পর্যাপ্ত পরিমানে খামারীদের উৎপাদিত পণ্য থাকার পরেও বিদেশ থেকে আমদানী করে বৈদেশিক মুদ্রার অপচয় ইত্যাদি আগ্রাসনের পরেও কৃষক, গৃহস্থ্য, মৎস্যজীবী ও খামারীগণ বিশেষ করে প্রানিত্বক পর্যায়ের কৃষক, গৃহস্থ্য, মৎস্যজীবী ও খামারীগণ নিরবচ্ছিন্ন ভাবে সারা বছর দেশের মানুষের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য ও পুষ্টির যোগান দিয়ে আসছে। তারপরও ক্ষুদ্র কৃষক, মৎস্যজীবী ও খামারীদেরকে নানা প্রতিকুরতার বিরুদ্ধে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়আতংকে আছেন ড্রাগন চাষীরা। কৃষি উদ্যোক্তা একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক। কার পর তিনি ভবিষতের কথা চিন্তা করেই আগাম ভাবে বিভিন্ন ফলের বাগান করেছেন। তিনি আরো বলে বর্তমান সময়ে বয়কটের ট্রেন্ড চালু হয়েছে। ফলে কৃষকের মাঝে নতুন করে আতংক শুরু হয়েছে। ফেসবুক ও ইউটিউবে এক শ্রেণির তথাকথিত সোসাল এক্টিভিস্টের তরমুজ বয়কটের ডাকে মানুষ সাড়া দেয়ায় আমরা দেখেছি ব্যবসায়ীদের তরমুজ বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। তাদের তরমুজ পচেঁ যাচ্ছে। অনেকে বিক্রি করতে না পারায় ফেলে দিয়েছে। এতে যেটি হয়েছে ব্যবসায়ীরা সামান্য ক্ষতিগ্রস্থ্য হলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছেন আমাদের কৃষকরা। কারণ ক্রেতারা তরমুজ না কেনায় কৃষকের তরমুজ বিক্রি হয় নি। উদ্যোক্তা মিজান বলেন, বিভিন্ন মাধ্যমে আমরা জেনেছি ব্যবসায়ীরা আমাদের তরমুজ কম দামে কিনে তাদের আড়ৎ পর্যন্ত নিতে এবং ভোক্তা পর্যায়ে বিক্রি করতে গিয়ে কয়েক পর্যায়ে চাঁদা দিতে হয় তাদের। ফলে বেশি দামে বিক্রি করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। তাদের কথা যদি সঠিক হয় তাহলে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলে এ সমস্যার সমাধান কিভাবে হবে? এভাবে প্রশ্ন ছোড়েন তিনি। কিছুক্ষণ থেমে হতাশ কন্ঠে তিনি বলেন, দেখুন না কিছু দিন আগে গরুর মাংশ বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছে। যদি বয়কট করা হয় এতে ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে কে? নিশ্চয় গরু খামারীরা। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে তারা গরু পালন ছেড়ে দিবে। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে গরু আনা হবে। এখানেও চাঁদাবাজি ও গোখদ্যের দাম বৃদ্ধিই মূল সমস্যা। কিন্তু এ সমস্যা দেখার কেউ নেউ। আক্ষেপ করে মিজান বলেন যে কারণে দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে সেগুলো নিরসনে কোন ইউটিউবার কিংবা কোন ফেসবুকার জনমত গড়ে তুলতে কাজ করছেনা। তিনি আরো বলেন, এবার ড্রাগনের সিজনে হয়তো ড্রাগন বয়কটের ডাক দেয়া হবে। এখানেও ক্ষতিগ্রস্থ্য হবে কৃষক। আর্থিক অনঠনে পড়ে কৃষক ড্রাগন চাষ ছেড়ে দিবে। এরপর পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে আনা হবে ড্রাগন। এভাবেই একে একে আমাদের সব সেক্টরগুলো বয়কটের কালো থাবায় ধ্বংশ হয়ে যাবে। শিক্ষিত তরুন যুবক যারা কর্মসংস্থানের আশায় কৃষি ও পশুপালন সেক্টরে এসে অনাবাদী জমিকে আবাদী জমিতে পরিনত করেছিল তারা আবার বেকার হয়ে পড়বে। প্রতিবাদী কন্ঠে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলেন কৃষি উদ্যোক্তা মিজানুরর রহমান এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের কাছে দাবী করেন যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের সমস্যা কেউ সৃষ্টি করতে না পারে সে দিকে তারা যেন নজর দেন। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতকরণে সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা অপরিহার্য। এ কথা সর্বজনস্বীকৃত যে, কার্যকর ও দক্ষ বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা ছাড়া কৃষিকে লাভজনক বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তর করা বেশ কঠিন। লাভজনক কৃষি খাত নিশ্চিতকরণে কৃষকের দরকষাকষির সামর্থ্য বড়ানোসহ কৃষকদের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সুযোগ তৈরি করতে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কথা সুস্পষ্ট ভাবে বর্ণিত রয়েছে জাতীয় কৃষি নীতিমালা, ২০১৮তে। উক্ত নীতিমালা বা পদক্ষেপসমূহ যথাযথ ভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে কৃষিপণ্যের সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠবে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়। সুষ্ঠু বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে উক্ত নীতিমালায় যেসব বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো কৃষিপণ্যে মূল্য সংযোজন ও ভ্যালু চেইনের উন্নয়ন ঘটা।আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষিপণ্যের অপচয় রোধ করার মাধ্যমে কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন কার্যক্রম যেমন প্যাকেজিং, লেবেলিং ও ব্র্যান্ডিং তথা জিআই প্রডাক্ট হিসেবে চিহ্নিতকরণ ইত্যাদি কার্যক্রমের জনপ্রিয়করনে সম্প্রসারন সেবা বাড়ানো ও এর সুফল সম্পর্কে ব্যাপক প্রচার চালানো গেলে সবাই উদ্বুদ্ধ হবে। বিপণনের পূর্বশর্ত মানসম্মত কৃষিপণ্য উৎপাদন। এটি নিশ্চিত করার জন্য উত্তম কৃষিচর্চার বাস্তব প্রয়োগ ঘটার বিকল্প নেই। রপ্তানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে এটি বেশ কার্যকর। রপ্তানিযোগ্য পণ্য বহুমুখীকরণের মাধ্যমে রপ্তানি বাজার অনুসন্ধান করা গেলে ফার্মিংয়ের সুযোগ বাড়বে। এটি করতে কৃষক সংগঠন তৈরি করা বা বিদ্যমান সংগঠন গুলোকে অধিক শক্তিশালী করা দরকার। এ নিয়ে কথা হয় কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহবুব আলম রনির সাথে। তিনি জানান, উপজেলায় প্রায় ১৬৫ হেক্টর জমিতে ড্রাগন চাষ হচ্ছে। চাষীরা যাতে টনিক ব্যবহার না করে সে ব্যপারে তাদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। সম্প্রতি ঝিনাইদহ জেলা ড্রাগন চাষী কল্যাণ সমিতির সদস্যরাও টনিক বর্জনের ঘোষনা দিয়েছেন। দেশে ড্রাগন উৎপাদন চাহিদার তুলনায় বেশি হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ড্রাগন চাষ মূলত ঝিনাইদহ জেলায় বেশি হচ্ছে অন্য এলাকায় এ ফলের চাষ খুবই কম। তাই এমন আশংকার কথা তিনি ভাবছেন না। ড্রাগন অনেক পুষ্টিগুন সম্পন্ন একটি ফল। এ ফল শিশু থেকে বৃদ্ধরা খেতে পারে। তিনি ব্যাক্তিগত ভাবে সবাইকে এ ফল খাওয়ার জন্য আহ্বান জানান।