চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের অবহেলায় ও ভুল চিকিৎসায় একের পর এক প্রসূতি বা নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। চলতি মাসের শেষ দু’সপ্তাহেই মাগুরায় এক মা ও নবজাতক এবং বাগেরহাটে এক প্রসূতির মৃত্যু হয়েছে। এসব ঘটনায় দেখা যায় রোগীর স্বজনরা বিক্ষুব্ধ হয়ে হাসপাতাল ভাঙচুর ও চিকিৎসক-নার্সদের মারধর করে। পরবর্তীতে এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। অন্যদিকে চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষ দাবি করে মৃত্যুর ঘটনায় তাদের কোনও গাফিলতি ছিল না। কর্তৃপক্ষ কয়েক সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করে, যেগুলোর বেশিরভাগক্ষেত্রেই তাঁরা কী প্রতিবেদন দিচ্ছেন বা পরবর্তী ফলফল কী দাঁড়ায় তা আমরা জানতে পারি না।
গত তিন দশকে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে, প্রসূতি মায়েদের মৃত্যুহার কমেছে, শিশুদের মৃত্যুর হার কমেছে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি-পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতির ফলে খর্বাকৃতি ও কৃষকায় শিশু জন্মের হার কমেছে। এগুলো একদিনে সম্ভব হয়নি। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে, অনেক প্রচেষ্টার ফলে এই পর্যায়ে পৌঁছানো গেছে। কিন্তু এখন এই অর্জনকে নষ্ট করা কোনোভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
এদিকে, প্রসূতি-নবজাতকরা অবহেলা ও ভুল চিকিৎসার শিকার হবার পাশাপাশি তাঁদের জন্য আরেকটি উদ্বেগের বিষয় হলো অপ্রয়োজনীয় সিজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি দেশে সিজারিয়ান অপারেশনের হার হবে মোট প্রসবের ১০ থেকে ১৫ ভাগ। অথচ ২০১৬ সালের হিসেবে বাংলাদেশে এই হার ৩১ ভাগ। ২০১০ সালে এই হার ছিল ১৯ ভাগ। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’র মতে বাংলাদেশে গত দুই বছরে শিশু জন্মের ক্ষেত্রে সিজারিয়ানের হার বেড়েছে ৫১ শতাংশ। বিষয়টিকে অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার উল্লেখ করে সংস্থাটি বলেছে, এতে বাবা-মায়েদের সন্তান জন্মদানে ব্যাপক পরিমাণে খরচের ভার বহন করতে হচ্ছে। সিজারিয়ান অপারেশনের এই হার বৃদ্ধিকে উদ্বেগজনক বলে হাইকোর্টে একটি রিটও করা হয়। পরে অপ্রয়োজনীয় সিজার রোধে ৬ মাসের মধ্যে একটি নীতিমালা করার নির্দেশ দেন হাই কোর্ট। নীতিমালা করার পর তা হাই কোর্টে দাখিল করতেও আদেশে বলা হয়। গত জুনে দেওয়া সেই আদেশের তিন মাস পেরিয়ে গেছে। আশা করা যায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সরকার এটি পরিপূর্ণ নীতিমালা তৈরি করতে সক্ষম হবে। পাশাপাশি সেবা প্রদানের চেয়ে ক্লিনিক-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অধিক মুনাফালাভের মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে এবং চিকিৎসকদের আন্তরিকতা বৃদ্ধি করতে হবে। আর অবহেলা ও ভুল চিকিৎসায় প্রসূতি ও নবজাতকের মৃত্যুর ঘটনাগুলো নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে দায়ীদের চিহ্নিত করে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যাতে এগুলো দৃষ্টান্ত হয়ে থাকে। একটি অপমৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়।