মাত্রাতিরিক্ত লাভ করতে গিয়ে পেঁয়াজ আমদানিকারকদের এখন লোকসানের বোঝা টানতে হচ্ছে। কারণ মূল্যবান বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা টনে টনে আসা আমদানির পেঁয়াজে পচন ধরেছে। বর্তমানে পেঁয়াজ ঝাঁজ হারিয়ে বন্দরে, আড়তে শত শত বস্তা পচা পেঁয়াজ দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। পাইকারি বাজারে ঘটেছে ব্যাপক দরপতন। অনেককেই ময়লার ভাগাড়ে পচা পেঁয়াজ ফেলে দিতে বাধ্য হচ্ছে। বেসরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমদানিকৃত পেঁয়াজ পচে এখন পর্যন্ত ৮০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা পাওয়া গেছে। আর এ হিসাব শুধুমাত্র দেশের একক বৃহত্তম ভোগ্যপণ্যের পাইকারি বাজার চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীদেরই। খাতুনগঞ্জ পাইকারি বাজার সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, প্রতিবেশী দেশ ভারত গত ২৯ সেপ্টেম্বর থেকে এদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়। আর সঙ্গে সঙ্গেই অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে দেশের বাজার। প্রতিদিনই পেঁয়াজের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে খুচরা পর্যায়ে প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য সর্বোচ্চ ১৩০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। ওই সময়ে এককেজি আপেলের মূল্যের চেয়েও প্রতিকেজি পেঁয়াজের মূল্য বেশি দাঁড়ায়। এমন অবস্থায় সরকারের পক্ষে পেঁয়াজ আমদানির আহ্বান জানানো হয়। বাজার পরিস্থিতি সহনশীল পর্যায়ে রাখার লক্ষ্যে সরকার টিসিবির মাধ্যমেও পেঁয়াজ আমদানির ব্যবস্থা করা হয়। পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে আমদানিকারকদের মধ্যেও পেঁয়াজ আনার প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয়ে যায়। পেঁয়াজ আমদানির জন্য অনেকেই ব্যাংকে এলসি খুলে বসে। প্রতিটন ৫শ’ ডলারের ওপরে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পেঁয়াজের বুকিং হয়ে যায়। কিন্তু ওই পেঁয়াজ আসার পথে যে সময় নেয় এবং পরবর্তীতে আড়তে পর্যন্ত পৌঁছানোর পর তাতে পচন ধরে যায়। ফলে খাতুনগঞ্জের পাইকারি আড়তে পেঁয়াজের ঝাঁজের বদলে মিলছে পচা গন্ধ।
সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতিদিন পচা পেঁয়াজ সিটি কর্পোরেশনের গাড়িযোগে তুলে নেয়া হচ্ছে। ফেলে দেয়া হচ্ছে কর্পোরেশনের ময়লার ভাগাড়ে। মূলত অতি মুনাফার লোভে পেঁয়াজ সঙ্কটকে পুঁজি করে অনভিজ্ঞ ব্যবসায়ী পেঁয়াজ আমদানিতে ঝুঁকে পড়ায় এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কারণ তারা মানের দিকটি যেমন বিবেচনায় আনেনি, তেমনি বুকিং রেট নিয়ে হিসাব কষা হয়নি। ফলে রেফার কন্টেনার বোঝাই হয়ে পেঁয়াজ যখন বন্দরে খালাস হয়েছে তখনই অধিকাংশে গ্যাজ উঠে গেছে। বস্তা বোঝাই হয়ে আসা ওসব পেঁয়াজের কিছু পরিমাণ পচে রস পড়ার বিষয়টিও লক্ষণীয়। এভাবে ট্রাক বোঝাই হয়ে যখন পেঁয়াজের চালান আড়তে পৌঁছেছে তখন কিছু বস্তা পুরোপুরিভাবে এবং কিছু বস্ত অর্ধ পচা অবস্থায় খুলতে হয়েছে। চীন, মিসর, মিয়ানমার, তুরস্ক, পাকিস্তান, নিউজিল্যান্ড, ইরান এবং হল্যান্ড থেকে আসা পেঁয়াজের চালানের একই অবস্থা। ফলে ৫শ’ ডলারের উপরে প্রতিটন কেনা পেঁয়াজ এখন অর্ধেক, এমনকি অর্ধেকের কমেও বিক্রির ক্রেতা মিলছে না। বরং দিন যতোই গড়াচ্ছে, পেঁয়াজের পচন প্রক্রিয়া ততোই বাড়ছে।
সূত্র আরো জানায়, তুরস্ক, মিসর, হল্যান্ড, ইরান, নিউজিল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে পেঁয়াজ পৌঁছতে কমপক্ষে ৩০ দিন, পাকিস্তান-চীন, মিয়ানমার থেকে আমদানি প্রক্রিয়াসহ পণ্য পৌঁছাতে সময় লাগে ২০ দিন। পেঁয়াজ যেহেতু পচনশীল পণ্য সেক্ষেত্রে রেফার কন্টেনারযোগে আমদানি করা হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে কিছু ব্যবসায়ী তড়িঘড়ি করেও পেঁয়াজ নিয়ে এসেছে। বিপরীতে দেশ থেকে চলে গেছে মোটা অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ ডলার। এখন খাতুনগঞ্জের আড়তে প্রতিকেজি পাকিস্তানি পেঁয়াজ ২০ থেকে ২৫, মিসর, তুরস্ক ২৫ থেকে ৩০, মিয়ানমার ২০ থেকে ২২, চীনের ১৫ থেকে ২০ এবং ইরানি পেঁয়াজ ২৫ থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর যেসব পেঁয়াজে পচন ধরেছে সেসব পেঁয়াজ প্রতিবস্তা ৫ থেকে ১০ টাকায় আগ্রহী ক্রেতাদের দেয়া হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে মানসম্পন্ন পেঁয়াজের মূল্য কেজিপ্রতি ৩০ টাকা পর্যন্ত নেমে এসেছে। বর্তমানে খাতুনগঞ্জের প্রতিটি আড়তের সামনে শত শত পচা পেঁয়াজের বস্তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক ধারণা ইতিমধ্যে কমপক্ষে ৮০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। আর পেঁয়াজে লাভ তো দূরের কথা, আসল উঠানোরও সুযোগ নেই।
এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ী নেতাদের মতে, বাজার পরিস্থিতি নিয়ে কোন ধারণা নেই, চাহিদা নিয়ে কোন অভিজ্ঞতা নেই এমন ব্যবসায়ীরা যেনতেনভাবে এলসি খুলে পেঁয়াজ আনার এমন ঘটনা ঘটেছে।