বাংলাদেশে ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচন কখনোই সহিংসতামুক্ত ছিল না। কিন্তু এ বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে সহিংসতার মাত্রা কিছুটা বেশিই দেখা যাচ্ছে, এবং এবার সহিংসতায় আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যাচ্ছে। বোমাবাজির ঘটনাও বাড়ছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, শুক্রবার সন্ধ্যা পর্যন্ত নির্বাচনী সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন ৪০ জন। তাঁদের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন ২০ জন, যার মধ্যে পুলিশের গুলিতে মারা গেছেন দুজন। এসব ঘটনায় মূলত অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হলেও কিছু ক্ষেত্রে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্রেরও অপব্যবহার হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। অনেক নির্বাচন বিশ্লেষকই মনে করছেন, এবার তৃণমূলের এই নির্বাচনে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে গৃহীত পদক্ষেপের অপ্রতুলতাই বাড়তি সহিংসতার জন্য মূলত দায়ী।
অতীতে দেখা গেছে, প্রধান প্রধান নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ঝুঁকিপ্রবণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করা হতো এবং সে অনুযায়ী পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা গ্রহণ করা হতো। ফলে সেসব এলাকায় সহিংসতা অনেকটাই কম হতো। ইউপি নির্বাচনে সহিংসতার ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, মাত্র দুটি জেলায় সবচেয়ে বেশি সহিংসতা হয়েছে। জেলা দুটি হলো নরসিংদী ও কক্সবাজার। এর মধ্যে নরসিংদীতে ৯ জন এবং কক্সবাজারে পাঁচজন মারা গেছেন। নির্বাচনের আগেই অতিরিক্ত ঝুঁকিপ্রবণ হিসেবে জেলা দুটিকে চিহ্নিত করা গেলে এবং পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেওয়া হলে এ দুটি জেলার সহিংসতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। অনেক প্রাণ রক্ষা পেত। জানা যায়, নির্বাচনে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার বেশি হতে পারে এমন আশঙ্কা আগেই করা হয়েছিল। পুলিশের ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান জানিয়েছিলেন যে ঢাকা বিভাগের অর্ধেকের মতো ইউপি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ইউপিতে নির্বাচনের আগে বৈধ আগ্নেয়াস্ত্র জমা নেওয়ারও প্রস্তাব করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সেই প্রস্তাবে সায় দেয়নি। তাহলে এই নির্বাচনী সহিংসতা ও ব্যাপক প্রাণহানির দায় কার? কেউ কেউ এসব সহিংসতার জন্য রাজনৈতিক উসকানিকেও দায়ী করছেন। কিন্তু সেটি শুধু মুখের কথায় সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না, তদন্তের মাধ্যমে প্রমাণ করতে হবে এবং বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
নির্বাচনী সহিংসতায় যেভাবে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার হয়েছে, তা শুধু নির্বাচন নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দুর্বলতাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। আবার অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার যদি বেড়ে যায়, তখন বৈধ অস্ত্র জমা নেওয়াটাও বিপজ্জনক। কারণ মানুষ তার নিজের নিরাপত্তার জন্যই বৈধ অস্ত্র রাখেন। বৈধ হোক, অবৈধ হোক, নির্বাচনে যেসব জায়গায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহূত হয়েছে, সহিংসতা হয়েছে, সব ঘটনা দ্রুত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রয়োজনে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করতে হবে। নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায়ও প্রাণহানির অনেক ঘটনা ঘটছে। এই সংঘাতময় পরিস্থিতি কঠোর হাতে দমন করা না হলে হতাহতের সংখ্যা শুধু বাড়তেই থাকবে। ভবিষ্যতের নির্বাচনেও এর প্রভাব পড়বে। কাজেই এই অপসংস্কৃতি বন্ধে নির্বাচন কমিশন ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সচেষ্ট হবে এটাই প্রত্যাশা।