বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। এই বনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে রয়েছে উপকূলবাসীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা। জীবিকা নির্বাহের ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের আগে তাদের বড় আতঙ্কের নাম ছিল সুন্দরবনের জলদস্যু-বনদুস্য। দীর্ঘদিন ধরে সুন্দরবনকে ঘিরে ৩২টি দস্যুগ্রুপ গড়ে উঠেছিলো। এসব গ্রুপের শত শত সদস্য দাপিয়ে বেড়াত বনের ছোট, বড় সকল খালে। বনকে ঘিরে যারা জীবিকা নির্বাহ করত তারা ছিলো দস্যুদের কাছে অসহায়। দস্যুদের চাঁদা না দিলে কেউ বনে প্রবেশ করতে পারত না। এমনকি অপহরণের ঘটনা ছিলো নিয়মিত বিষয়। মুক্তিপণ হিসেবে দস্যুরা লাখ লাখ টাকা দাবি করত। টাকা পেলেই মুক্তি পেত অপহৃত ব্যক্তি। পরে অবস্থার পরিবর্তন হয়। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করেন। তারপর থেকে অনেকটাই স্বস্তিতে ছিল সুন্দরবন। এর আগে ২০১৫ সাল থেকে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত করতে দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালিত হয়। এসব অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছেন র্যাবের সদস্যরা। তখন র্যাবের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন বর্তমান আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ। তিন বছর ধরে পরিচালিত অভিযানে শতাধিক দস্যু প্রাণ হারান আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। ২০১৬ সালের ৩১ মে থেকে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর পর্যন্ত সুন্দরবনের ৩২টি বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ জমা দিয়ে আত্মসমর্পণ করে। এ সময় তারা ৪৬২টি আগ্নেয়াস্ত্র, ২২ হাজার ৫০৪ রাউন্ড গোলাবারুদ জমা দেয়। আত্মসমর্পণকারীদের মধ্যে ১০২ জনকে দেওয়া হয় ঘর, ৯০ জনকে মালামালসহ মুদি দোকান, দেওয়া হয় ১২টি জালসহ মাছ ধরার নৌকা, ইঞ্জিন চালিত নৌকা দেওয়া হয়েছে ৮টি আর গবাদিপশু দেওয়া হয় ২২৮ টি। অপহরণ ও হত্যার ঘটনা এখন আর নেই। জেলে বা মৌয়ালদের কষ্টার্জিত আয়ে কাউকে ভাগ দিতে হচ্ছে না। নির্ভয়ে পর্যটকরা সুন্দরবনে যাচ্ছেন। আত্মসমর্পণকারী দস্যুদের কেউ কেউ বলছেন, তারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে অনেক ভালো আছেন, পুরনো পেশায় ফিরে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই নেই। পরিবার-পরিজন নিয়ে শান্তিতে থাকায় নতুন করে কোন ঝামেলায় জড়াতে চান না তারা। তবে কিন্তু শান্তির এই সুবাতাস ধরে রাখাই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য চ্যালেঞ্জ। তাদের আশঙ্কা আত্মসমর্পণকারী দস্যুরা কারো প্রলোভনে পড়ে আবার যেন পুরনো পেশায় ফিরে না যায়। সেরকম কিছু অপচেষ্টার খবর তাদের হাতে রয়েছে। তবে কঠোর অবস্থানে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তারা বলছেন, পুরনো দস্যু পেশায় ফিরে গেলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
এদিকে দস্যুমুক্ত ঘোষণার তিন বছর পর সুন্দরবনসংলগ্ন বঙ্গোপসাগরে আবার জলদস্যুদের তা-ব শুরু হয়েছে। সম্প্রতি বাগেরহাটের শরণখোলার দুটি এবং বরগুনার পাথরঘাটার একটি মাছ ধরার ট্রলারে ডাকাতি হয়েছে। দস্যুদল এসব ট্রলার থেকে তিন জেলেকে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করেছে। দস্যুদের কবল থেকে ফিরে আসা কয়েকজন জেলে জানান, বঙ্গোপসাগরে মাছ ধরারর সময় ২০ থেকে ২৫ জনের একটি সশস্ত্র দস্যুদল নামবিহীন একটি ট্রলারে এসে একের পর এক জেলে ট্রলারে হামলা চালায়। তারা জেলেদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে টাকা ও মালপত্র লুট করে। যাওয়ার সময় তারা দুই মাঝিকেও তুলে নিয়ে যায়। একেকজনের মুক্তিপণ হিসেবে তিন লাখ টাকা করে দাবি করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করার পর পালিত হয়ে আসছে দস্যুমুক্ত দিবসও। কিন্তু এরইমধ্যে আবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে দস্যুরা। গত বছর এর তৃতীয় বর্ষপূর্তি ও আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সাবেক দস্যুদের পুনর্বাসন সহায়তা প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেছিলেন, সুন্দরবনের জলে, স্থলে, বনে কোথাও আর দস্যুতা করতে দেয়া হবে না। দস্যুতা রোধে র্যাবের স্থায়ী ক্যাম্প নির্মাণ করা হবে। প্রয়োজনে কোস্টগার্ডসহ অন্য বাহিনীকে আরো শক্তিশালী করা হবে। দস্যুতা ছেড়ে যারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন তাদের নামে থাকা ধর্ষণ ও খুনের মামলা ছাড়া অন্য সব মামলা পর্যায়ক্রমে তুলে নেয়ার আশ্বাস দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সাবেক দস্যুদের পুনর্বাসন করা হয়েছ। যদি কেউ আবার বিপথে যান, তবে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীও বসে থাকবে না। তবে দীর্ঘদিন পর জলদস্যুদের উৎপাতে আতঙ্কিত জেলে ও ট্রলার মালিকরা। তাদের ধারণা, আত্মসমর্পণ করা দস্যুরাই ভিন্ন কৌশলে তৎপর হয়ে উঠেছে। মৎস্যজীবী নেতাদের অভিযোগ, ২০১৮ সালে জলদস্যু আত্মসমর্পণের পর কমে যায় নজরদারি। বরগুনা ট্রলার শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আবদুল মান্নান বলেন, হিরন পয়েন্টে র্যাবের ঘাঁটি যদি হতো তাহলে জলদস্যু, বনদস্যু কেউই কোন সাহস পেতো না। বরগুনা ট্রলার শ্রমিক সমিতির সভাপতি গোলাম মোস্তফা চৌধুরী বলেন, যদি পাথরঘাটায় একটা ক্যাম্প হয় তাহলে বলেশ্বর ও বিশখালী নদীতে যে মাদক ও বিভিন্ন ধরণের জিনিস যে পাচার হয় এগুলো বন্ধ হয়ে যেতো। নতুন করে ক্যাম্প স্থাপনের বিষয়ে কিছু না বললেও কঠোর হাতে জলদস্যু দমনের আশ্বাস র্যাব প্রধানের। র্যাব মহাপরিচালক চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, লোকাল চাহিদা ও আমাদের অ্যাসেসমেন্ট অনুযায়ী আমাদের যেটা করা দরকার ঠিক ওই ব্যবস্থা নেবো। এটা আমি আশ্বস্ত করতে চাই ডাকাতি যে করবে তার জন্য তা করা দরকার সেটা সুনিশ্চিতভাবে করা হবে। এদিকে জানা গেছে, নিয়মিত অভিযান পরিচালিত হওয়ায় কোণঠাসা হয়ে পরেছে জলদস্যুরা। যে কারণে দস্যুরা সুন্দরবনের ভেতরে ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারায় সমুদ্রে এখন ডাকাতি কার্যক্রম শুরু করছে। বলেশ্বর নদী থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে সমুদ্র এলাকায় জলদস্যুরা ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, প্রাথমিক তথ্যানুযায়ী আমরা জানতে পারি, সুন্দরবনে আমাদের আভিযানিক সক্ষমতা অনেক বেড়েছে এবং আমরা সুন্দরবনে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। তাই দস্যুরা সুন্দরবনের ভেতরে ডাকাতি কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পেরে সমুদ্রে ডাকাতি কার্যক্রম শুরু করছে। দস্যুদের অধিকাংশ সদস্যকে ইতোমধ্যে আমরা গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকি সদস্যদের গ্রেফতারের জন্য আমাদের অভিযান চলছে।