সাগরে ঝড়ের কবলে পড়ে মাছধরা ট্রলারডুবির ঘটনায় নিহতের বাড়িতে চলছে শোকের মাতম। বুধবার সকালে চারজনের মরদেহ বাগেরহাটে পৌছায়। এর মধ্যে রহুল হাওলাদার, শহিদুল মল্লিক ও সহিদ বাড়ি কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামে। অপর জন আনেয়ার হোসেন বাদলের বাড়ি পাশের গ্রাম আন্ধারমানিকে। নিহতদের বাড়ি মরদেহগুলো পৌছালে স্বজনদের কান্নায় আকাশ-বাতাশ ভারি হয়ে উঠে। চারদিক থেকে এলাকাবাসী ও আত্মীয়স্বজন ছুটে আসেন নিহতদের বাড়িতে। স্বজনদের আহাজারি ও প্রতিবেশীদের চোখের পানিতে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য সৃষ্টি হয় বগা গ্রামে। বগা গ্রামে এখনও দুইজন জেলে নিখোঁজ রয়েছে। কারও ভাই, কারও সন্তান, কারো বাবা ও কারও স্বামী হারিয়ে এখন পাগল প্রায় নিহতদের পরিবারগুলো। পরিবারের একমাত্র কর্মক্ষম সদস্যকে হারিয়ে অনিশ্চতার মধ্যে পড়েছেন নিহতের স্বজনরা। নিহতের পরিবারগুলোকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদানের ঘোষনা দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। এখনও যেসব জেলে নিখোজ রয়েছে উদ্ধারে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে বন বিভাগ।
বুধবার সকালে বগা গ্রামের নিহত রুহুল আমিনের বাড়িতে প্রবেশ করতেই তার স্বজনদের আহাজারি চোখে পড়ে।ঘরের চাল থেকে দীর্ঘদিনের মরিচাপড়া টিনগুলো খসে পড়ছে। ঘরের বেড়াগুলোও জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। রুহুলের আয়ে কোন মতে জীবন টিকে ছিল তাদের। এই অবস্থায় রুহুলকে হারিয়ে সংকটে পড়েছে পরিবারটি।
রুহুলের স্ত্রী রুমিচা বেগম বলেন, ১লা ফেব্রুয়ারি রাতে আনিস সরদারের এফবি মায়ের দোয়া ট্রলারে সাগরে ইলিশ আহরণ করতে যায় আমার স্বামী। শুক্রবার রাতের ঝড়ের কবলে পড়ে নিখোজের খবর পাই আমরা রোববার । এলাকার লোকজন আজ আমার স্বামীর মরদেহ বাড়িতে নিয়ে আসছেন। আমার ঘর নাই, চাল নেই, দিন আনি দিন খাই। ১২ বছরের এখলাছ ও ৮ বছরের ইয়াছিনকে নিয়ে আমি কিভাবে চলব। কিভাবে এদের পড়াশুনা করাব। কোথায় যাব, কার কাছে যাব এই বলে বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় এলাকার অনেকেই চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি।
ট্রলার ডুবির ঘটনায় রুহুলের প্রতিবেশী আবুবকর মোল্লা এখনও নিখোজ রয়েছেন। তার বাড়িতে চলছে মাতম। আবু বকরের স্ত্রী লামিয়া বেগম বলেন, আড়াই বছরের আয়শা ও তিন মাস বয়সী আবিদ নামের দুটি সন্তান রয়েছে আমাদের। সাগরে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোজ হওয়ার পরে এখনও বাড়িতে ফেরেনি আমার স্বামী। জমি-জমাও নেই। অন্যের জমিতে ঘর বেধে থাকি আমরা। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থাও খুবই খারাপ। শিশু সন্তানদের নিয়ে এখন আমি কোথায় যাব!
আবুবকরের মা হাজেরা বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বলেন, বাবার লাশটা যদি পাই, তাহলে বাড়িতে এনে কবর দিতে পারতাম। যতদিন বেঁচে থাকতাম বাবার কবর দেখেও মনকে বুঝ দিতে পারব। বাবার সন্তানদের বলতে পারব তোমার বাবা এখানে শুয়ে আছেন।
শুধু রুহুল ও আবুবকরের পরিবার নয়, নিহত ও নিখোজ প্রত্যেকের পরিবারের একই অবস্থা। প্রত্যন্ত এলাকার এই গ্রামের বেশিরভাগ মানুষের পেশা সাগরে মাছ ধরা। দীর্ঘদিন ধরে জীবনের ঝুকি নিয়ে মাছ আহরণে গেলেও আর্থিক অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি তাদের। পেশাগত কাজে সাগরে থাকা অবস্থায় নিহত বা আহত হলে কোন প্রকার সহযোগিতাও পান না তারা। দরিদ্র এই পরিবার গুলোর অনেকের বাসস্থানেরও অভাব রয়েছে। এর আগেও বিভিন্ন সময় যারা নিখোজ রয়েছে, তাদের পরিবারগুলোও পায়নি কোন সহযোগিতা।
বগা গ্রামের মাছ ব্যবসায়ী ইব্রাহীম আমানী বলেন, আমাদের গ্রামটি মৎস্যজীবী গ্রাম। আমাদের বাব-দাদার পেশা সাগরে মাছ ধরা। যুগের পর যুগ সাগরে মাছ ধরলেও আমাদের ভাগ্যের কোন পরিবর্তণ হয় না। বিভিন্ন সময় মারাও যায় অনেকে। আজকে যারা মারা গেল তাদের পরিবারগুলোর স্বচ্ছলতার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সহযোগিতা চাই। তাদেরকে এমন একটি ব্যবস্থা করে দেওয়া হোক যাতে নিহতের সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারেন।
নিহতদেরর পরিবারগুলো পূর্নবাসনের জন্য সরকারী সহয়তার দাবী জানিয়ে কচুয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নাজমা সরোয়ার বলেন, নিহত হলে উপজেলা পরিষদ থেকে যে সহযোগিতা করা হয়, তার পরিমান সামান্য। আমরা চাই এসব পরিবারকে পুনর্বাসিত করে তাদের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা। এজন্য সরকারের কাছে আমি জোর দাবি জানাই।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, নিহত প্রত্যেকের পরিবারকে ২০ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে। এ ছাড়া যারা নিখোঁজ রয়েছেন তাদেরও পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দেন জেলা প্রশাসনের শীর্ষ এই কর্মকর্তা।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাতে সাগরে মাছ ধরার সময় আকস্মিক ঝড়ের কবলে পড়ে সুন্দবনের দুবলার শুকটি পল্লী এবং উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি ট্রলার ডুবে যায়। এ সময় অনেক জেলে সাতিরে কুলে উঠতে পারলেও নিখ্জো হয় অন্তত ১০ জেলে। এরমধ্যে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার বগা গ্রামের এফবি মা-বাবা দোয়া নামের একটি ট্রলারের ১৪ জেলে মধ্যে ৭ জন নিখোজঁ হয়। এর আগে ২০১৫ সালের ২১ সেপ্টে¤॥^র ঝড়ের কবলে পড়ে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলা বগা গ্রামের ১৯ জেলে এখনও নিখোজ রয়েছে।