উপকুলীয় জনপদ কয়রায় কপোতাক্ষ নদের ভেঙে যাওয়া চোরমুখা গ্রামের রিংবাঁধ ফের সেচ্ছশ্রমে সংস্কার সম্পন্ন করেছে এলাকাবাসী। পাঁচ দিনের টানা প্রায় ৩ হাজার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে কপোতাক্ষের লোনা পানি লোকালয়ে প্রবেশ ঠেকাতে পেরেছে তারা। বুধবার ভোরের আলো ফোটার আগেই এলাকাবাসিকে ঝুড়ি আর কোদাল নিয়ে বেড়ীবাঁধে আসার জন্য ঘোষনা দেয় প্রতিটি মসজিদ থেকে। সেই আহবানে নিজেদের রক্ষার তাগিদে ভাঙা বাঁধের কাছে একের পর এক কোদাল হাতে জড়ো হতে শুরু করে হাজার হাজার মানুষ। নদীতে ভাটার টানে পানি নামতে শুরু করলেই হাতে হাত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে শুরু হয় কাজ। দুপুরে নদীতে জোয়ার আসার আগ পর্যন্ত একটানা মাটি কেটে, বাঁধ উঁচু করার চেষ্টা চলে। প্রথমে ভাঙন কবলিত বাঁধের কিছুটা দূর থেকে বাঁশ পুতে টিনের বেড়া দিয়ে পানির প্রবাহ কিছুটা কমিয়ে ফেলা হয়। এরপর রাস্তায় মাটি ভরে টিনের বেড়া ঘেঁষে মজবুত করে রাস্তা তৈরী করে হাতে হাতে মাটি দিয়ে বাঁধ উঁচু করা হয়। এভাবেই শেষ করা হয় বাঁধ নির্মান কাজ। বুধবার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) ১৪/১ নম্বর পোল্ডারের আওতাধীন খুলনার কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের চরামুখা এলাকায় গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা গেছে। স্থানীয় এলাকাবাসিরা জানান, গত ৪ দিন বাঁধ মেরামতের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলেও আজ পঞ্চমদিনে সাধারণ মানুষের সেচ্ছাশ্রমের প্রচেষ্টায় তাঁরা পুনরায় রিং বাঁধ দিয়ে কপোতাক্ষের নোনা পানি আটকাতে সক্ষম হয়েছে। তবে শুধু এবারের বাঁধ ভাঙনে না, প্রতি দুর্যোগের পর এভাবেই ভাঙা বাঁধ মেরামতে স্থানীয় মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হয় বলে জানালেন তাঁরা। স্থানীয় ইউপি সদস্য ওসমান গনি খোকন বলেন, এর আগে গত ১৭ জুলাই ভোরে চরামুখার এই বাঁধের প্রায় ৩০০ মিটারের মতো ধ্বসে যায়। সে সময় ভাঙা স্থানে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকানো সম্ভব হয়। এরপর ১৩ আগস্ট শনিবার দুপুরে উচ্চ জোয়ারে ওই রিং বাঁধটি পুনরায় ভেঙে যায়। সেই থেকে টানা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে যাচ্ছে এলাকার বাসিন্দারা। গত মঙ্গলবার এলাকাবাসী বাঁধ মেরামতে প্রাণপণ চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। বাঁধ নির্মাণ শেষে প্রবল জোয়ারে সেটি ভেঙে আবারো লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এই ভাঙনে কপোতাক্ষের নোনা পানিতে ডুবে যায় ১০টির বেশি গ্রাম। পানিবন্দি হয়ে পড়ে ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। স্থানীয় লোকজন বলেন, ইউনিয়নটির চরামুখা, হলুদবুনিয়া, মেদেরচর, বীণাপানি ও দক্ষিণ বেদকাশি গ্রামের প্রায় ছয় হাজার বিঘা জমির চিংড়ি ঘের তলিয়ে গেছে। পানির তোড়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার পাকা রাস্তা ধসে গেছে। সেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে আসা স্থানীয়রা জানায়, নিজেদের ঘর বাড়ি রক্ষায় বাঁধ সংস্কারের বিকল্প নেই, তাই সবাই মিলে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করতে এসেছেন তারা। সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় টানা কয়েকদিন কাজ করার পরে আজ রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারায় খুশি সবাই। কয়রা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির সভাপতি প্রভাষক বিদেশ রঞ্জন মৃধা বলেন, একমাস আগে নির্মান করা বাঁধ কর্তৃপক্ষের গাফিলতির কারণে পুনরায় ভেঙেছিল। টানা ৫ দিন স্বেচ্ছাশ্রমে ঘাম ঝরিয়ে কয়রার সাধারণ মানুষ আবারও বাঁধটি আটকাতে পেরেছে। এবার পারিশ্রামিকের বিনিময়ে প্রতিনিয়ত সংষ্কার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে কর্তৃপক্ষকে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকে রিং বাঁধটি তদারকি করা হোক। বেড়িবাঁধ সংষ্কার না করে যত উন্নয়নই করা হোক না কেন তা ভেসে যাবে পানির সাথে, উপকুলীয় অঞ্চলের উন্নয়ন শুরু হওয়া উচিত এইসব বেড়িবাঁধ সংষ্কার এর মাধ্যমে। কয়রায় দীর্ঘদিন পরে মজবুত বাঁধের জন্য বরাদ্দ হয়েছে। তবে এটা হবার কথা ছিল আরও আগে, যাইহোক দেরিতে হলেও পেয়েছি। এখন দ্রুত বাস্তবায়ন হোক এটাই চাই। বারবার চরামুখা এলাকার বাঁধ ভেঙে যাওয়ার পেছনে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতিকেই দুষছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের দাবি, এক মাস আগে রিং বাঁধ দেওয়া হলেও সেটি রক্ষণাবেক্ষণ বা মজবুত করার কোনো ব্যবস্থা নেয়নি পাউবো কর্তৃপক্ষ। এ কারনেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাঁধ মেরামতে আসা লোকজন অভিযোগ করেন, চরামুখার বাঁধটি সংস্কারের জন্য কর্তৃপক্ষকে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও তারা এড়িয়ে গেছে। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শাহনেওয়াজ তালুকদার বলেন, কয়রার দক্ষিণ বেদকাশী এলাকার স্থানীয় লোকজনের সহোযোগিতায় প্রাথমিক ভাবে পানি প্রবেশ রোধ করা গেছে। পাউবোর পক্ষ থেকে বেড়িবাঁধ মেরামতের জন্য বাঁশ ও জিও ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। এবার পাউবো সহায়তায় বাঁধ শক্তিশালী করার জন্য কাজ করা হবে। দক্ষিন বেদকাশি ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ আছের আলী মোড়ল বলেন, উপকূলীয় এলাকার টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য একটি মেগা প্রকল্প পাশ হয়েছে। সেটি বাস্তবায়ন হলে স্থায়ী ভাবে দুরবস্থা কেটে যাবে।