করোনা পরিস্থিতির ধাক্কা সামাল করতে না করতে বাংলাদেশে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানছে। রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রধান খাদ্য পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। ফলে দেশের মানুষের একটা বড় অংশ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছেন। পরিবারসহ নিজে টিকে থাকার জন্য কেউ ঋণ করছেন অথবা পরিবারের সম্পদ বিক্রি করছেন। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা ও বিপন্ন পদক্ষেপ’ শীর্ষক এক জরিপ প্রতিবেদনে এমন চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গত ১৩ অক্টোবর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর জরিপ করা হয় গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে দেশের আটটি বিভাগে।
জরিপে মানুষের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল, বিগত ছ’মাসে তাদের ওপর বড় আঘাত কী ছিল? জবাবে ৮৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যের চড়া দামকে বড় আঘাত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এ ছাড়াও রোগ ও চিকিৎসা ব্যয়, তেলের দাম ও পরিবহন ব্যয় এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগকেও মানুষ বড় আঘাত হিসেবে বিবেচনা করেছে। খাবার কিনতে হিমশিম খাওয়া মানুষের হার ৬৮ শতাংশ। সামগ্রিক ভাবে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তা-হীনতায় গত আগস্টে ছিলেন। হারটি জুলাই মাসের চেয়ে কম। ওই মাসে ২৯ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্য নিরাপত্তা হীনতায় ছিলেন। আর নিম্ম আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবন যাত্রা এবং খাদ্য পরিস্থিতি সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। গত আগস্ট মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙ্গেছে। আবার খাদ্য কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙ্গে ফেলেছেন। আট বিভাগের মধ্যে সিলেট ও বরিশাল বিভাগের মানুষ সব চেয়ে বেশি চাপের মধ্যে রয়েছে। এর হার ৭৫ শতাংশ। আর এ কারণ হিসেবে প্রাকৃতিক দুর্যোগকে দায়ী করা হচ্ছে। সিলেটের সাম্প্রতিক বন্যার ধকল এখনো কাটিয়ে উঠতে পারে নি সেখানকার মানুষ।
চলতি বছরের মে মাসের ওই বন্যায় সিলেট বিভাগের তিন চতুর্থাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ ধান নষ্ট হয়ে যায়। বোরো মৌসুমের ওই ধান হচ্ছে দেশের হাওর প্রধান সিলেট বিভাগের কৃষকদের বছরের একমাত্র ফসল। অন্যদিকে বরিশাল বিভাগের দারিদ্রের হার বেশি। খাদ্যপন্য ও জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার মানুষকে বেশি বিপাকে ফেলেছে। আর অনাবৃষ্টির কারণে মাঠের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সেখানকার মানুষেরা সংকটে পড়েছে। তবে সামগ্রিক ভাবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারগুলো খাদ্য পণ্যের দাম বাড়লেও তেমন সংকটে তারা পড়ে নি।
প্রতিবেদনে খাদ্য সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নানা উদ্যোগের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি খাতে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারি ভাবে রাশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে চাল ও গম আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখ গরিব মানুষের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার। সরকারের নেওয়া এতা সব উদ্যোগের পরও চাল ও গমের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি সবজি, ডিম, ডাল, মাছ ,চিনি, পেয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদের দাম নিয়মিত ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই ও আগস্টে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ ছড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির এ চাপ সামলাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষ খাদ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। অন্য সবজি না খেয়ে আলুর ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে।
কাজেই এখন আর প্রকল্প ভিত্তিক কর্মসূচি না দিয়ে একটি জাতীয় ত্রাণ তহবিল গঠন করে দীর্ঘ মেয়াদি খাদ্য কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আর সরকারি ও বেসরকারি অর্থ সহায়তা দিয়ে এ তহবিল গঠন করতে হবে। নইলে দেশের সামগ্রিক পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে পারে?