বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারি ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মে দিবসের প্রধান দাবি ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস লাখ লাখ সরকারি কর্মকর্তা, কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বাস্তবায়িত হলেও কোটি কোটি বেসরকারি শ্রমিক কর্মচারীরা এখনও ৮ ঘণ্টা কর্মদিবসের সুফল পায় না। বরং শ্রম আইনে কৌশলে ১০ ঘণ্টা কাজের ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিম্ন মজুরির ফাঁদে শ্রমজীবী মানুষকে এমনভাবে আটকে ফেলা হয়েছে যে শ্রমিকরা এখন বাধ্য হয় ওভার টাইম করতে, তা না হলে তার সংসার চালানো অসম্ভব।
কার্ল মার্ক্স হিসাব করে দেখিয়ে ছিলেন মালিকের মুনাফা বাড়ানোর পথ দুটি। শ্রমিকের শ্রম, সময় বাড়ানো আর যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ানো। ফলে কর্মঘণ্টা বাড়ছে, উৎপাদন বাড়ছে। সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকারত্ব। বিপুল সংখ্যক বেকার শ্রম বাজারে রিজার্ভ আর্মির কাজ করছে বলে কম মজুরিতেই তাদের কাজ করানো সম্ভব হচ্ছে।
প্রতি বছর শ্রমবাজারে কাজ প্রত্যাশী ২৫/২৬ লাখ তরুণ-যুবক আসে যাদের মাত্র দুই থেকে তিন লাখের মতো কর্মসংস্থান রাষ্ট্র করতে পারে। এরপর, কাজের জন্য মানুষ পাড়ি জমায় বিদেশে।আর বাকিরা দেশে কোনোমতে কাজ খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করে। দেশের প্রায় সাত কোটি ৩৭ লাখ শ্রমজীবীর মধ্যে প্রায় সাড়ে ত কোটি কাজ করে কৃষিখাতে। যেখানে বছরে ৪ মাসের বেশি কাজ থাকে না ফলে বহু ধরনের অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজের মাধ্যমে তারা টিকে থাকার চেষ্টা করে। এর বাইরে প্রায় ৪৫ লাখ শ্রমিক গার্মেন্টসে; ৩৩ লাখের বেশি নির্মাণ খাতে; ৫২ লাখ পরিবহন খাতে; ১৩ লাখের বেশি দোকান কর্মচারী; পাট, চা, চামড়া, তাঁত, রি রোলিং, মোটর মেকানিক, লবন, চিংড়ি, সংবাদমাধ্যম, হাসপাতাল-ক্লিনিক, পুস্তক বাঁধাই, হকার, রিকশা-ভ্যান চালক, ইজি-বাইক চালক, সিকিউরিটি গার্ডসহ বিভিন্ন খাতে কাজ করছে।
শ্রম শক্তির কিছু অংশ শ্রমিক প্রাতিষ্ঠানিক খাতে আর বাকিরা অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে থাকে। মজুরি বোর্ডের মাধ্যমে ৪৩টি সেক্টরের শ্রমজীবীদের নিম্নতম মজুরি নির্ধারণের ব্যবস্থা থাকলেও বাকি কোটি কোটি শ্রমিকের ‘কাজ নাই তো মজুরি নাই’ নীতিতে কাজ করানো হয়ে থাকে। শ্রমিকদের সংগঠিত হওয়ার পথে আইনি এবং আইন বহির্ভূত অসংখ্য বাধা। সে কারণে ২ লাখের মতো ছোট-বড় প্রতিষ্ঠান থাকলেও ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা ৮ হাজারের কম। দেশের প্রধান রপ্তানি খাত গার্মেন্টসে ৪ হাজারের বেশি কারখানা থাকলেও ট্রেড ইউনিয়ন আছে এমন কারখানা কাগজে কলমে ৬৬১টি। বাস্তবে সক্রিয় ট্রেড ইউনিয়নের সংখ্যা আরও কম। দেশের ৮টি ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই।
আইএলও কনভেনশন ৮৭ ও ৯৮ বাংলাদেশ ১৯৭২ সালে অনুসমর্থন করলেও স্বাধীনভাবে ট্রেড ইউনিয়ন করা ও পছন্দমত নেতা নির্বাচনের অধিকার থেকে শ্রমিকরা বঞ্চিত। ট্রেড ইউনিয়ন হলো শ্রমিকের ঐক্যবদ্ধ ও শিক্ষিত হওয়ার একমাত্র উপায় যা না হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও শ্রমিকরা অসহায়। মালিকদের ক্ষমতা আর শ্রম আইনের সহায়তা নিয়ে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করা ও টিকিয়ে রাখাকে দুঃসাধ্য করে ফেলা হচ্ছে। এবং এ কারণেই স্বল্প মজুরি আর দীর্ঘ কর্ম সময়ের দুষ্ট চক্রে বাধা পরে রয়েছে বাংলাদেশের শ্রমিক। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, মাথা পিছু আয় বাড়ছে। দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাতের শ্রমিকের সর্বনিম্ন মজুরি নির্ধারণ করা হয়েছে ৮ হাজার টাকা। ফলে উৎপাদনের প্রধান চালিকাশক্তি শ্রমিক মাথা পিছু আয়ের তুলনায় কম মজুরি পাঁচ্ছে এবং বৈষম্য ক্রমাগত আকাশচুম্বী হচ্ছে। মে দিবসের স্লোগানে এই বৈষম্যের কথাই মূর্ত হয়ে উঠছে। অপর দিকে
যন্ত্রের শক্তি মানুষের শ্রমকে লাঘব করবে। ফলে অল্প সময়ে বেশি উৎপাদন হবে- এই প্রত্যাশা থাকলেও বাস্তবে শ্রমিকের শ্রম সময় কমছে না। নারী শ্রমিকের শিল্পে আগমন বেড়েছে কিন্তু তাদের মাতৃত্ব, সংসারের কাজ নিয়ে দ্বিগুণ চাপ বহন করতে হচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে অতিরিক্ত পরিশ্রম এবং একঘেঁয়ে সাংসারিক কাজ নিংড়ে নিচ্ছে নারীদের শ্রমশক্তি। দ্রুত হারিয়ে ফেলছে সে তার কাজ করার ক্ষমতা। তাই দেখা যায় যে, শিল্প কারখানায় ৪০ বছরের বেশি বয়সী নারী শ্রমিক কাজ করতে পারছে না। অন্যদিকে কারখানার উচ্চপদে বা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃত্বে নারী শ্রমিকদের উপস্থিতি কম। ওভার টাইম আর যন্ত্র মিলে অল্প শ্রমিক দিয়ে বেশি কাজ করানোর ফলে কর্মক্ষম যুবশক্তির একটি বড় অংশ বেকার। এ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বিশ্বব্যাপী। এর মধ্যে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুচনা হয়েছে বলে যে ঘোষণা দিয়েছেন তা এখন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মুনাফা এবং মজুরির যে বিরোধ- সেই বিরোধে শ্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও দুর্বল এবং শোষিত। ফলে সারাদুনিয়াতে খাদ্য-পণ্য ও ব্যবহারিক পণ্য উৎপাদন সকল রেকর্ড ভেঙ্গে ফেললেও তা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে যাচ্ছে। আয়ের বড় অংশ খাদ্য, বাড়িভাড়া, পোশাক, চিকিৎসায় ব্যয় হয়ে যাওয়ার ফলে সঞ্চয় যেমন থাকছে না তেমনি দক্ষতা অর্জনের জন্য বাড়তি খরচ করাও শ্রমিকের জন্য সম্ভব হয়ে উঠছে না। তাহলে ডিজিটাল দক্ষতা শ্রমিকরা অর্জন করবে কিভাবে? চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কি তাহলে বেকারত্বের ভয়াবহতা নিয়ে আবির্ভূত হবে? উৎপাদন এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির এই দুষ্টচক্র সামাজিক সব শৃঙ্খলাকেই ভেঙ্গে ফেলবে। উৎপাদন বণ্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে ভারসাম্য আনা এবং আগ্রাসী পুঁজিবাদের হাত থেকে সমাজকে রক্ষা করতে হলে ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস ও ন্যায্য মজুরির কোনো বিকল্প নেই।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের পটভূমিতে মে দিবস বার বার সে কথাই মনে করিয়ে দিচ্ছেন।