উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরই শিক্ষার্থীদের অন্যতম চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। কিন্তু সেই ভর্তি পরীক্ষায় এখনো বিশৃঙ্খলা রয়ে গেছে। দেশে গুচ্ছ ভর্তি চালু হলেও তা এখনো পুরোপুরিভাবে সফলতা পায়নি। গুচ্ছ ভর্তিতে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা দেওয়ার পরও ভর্তির জন্য দৌড়াতে হয় এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরেক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বড় পাঁচ বিশ্ববিদ্যালয় এখনো আলাদা ভর্তি পরীক্ষা নিচ্ছে। এ ছাড়া মেডিকেল, ডেন্টালসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য শিক্ষার্থীদের পৃথক পরীক্ষায় বসতে হচ্ছে। ফলে ভোগান্তি কমছে না। প্রায় দুই দশক ধরে দেখছি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর আসনসংখ্যা কমবেশি বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু গত বছর ভর্তি পরীক্ষার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি সিদ্ধান্ত নেয়। সেই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে অধিকাংশ বিভাগে আসন কমানো হয়। ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষে যেখানে মোট শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়েছিল ৭ হাজার ২০০, সেখানে গত বছর আসন কমানোর কারণে এ সংখ্যা নেমে আসে ৬ হাজারে। এ বছরও আসনসংখ্যা বাড়েনি। অর্থাৎ, আগের তুলনায় আসন কমেছে ১ হাজার ২০০, যা শতকরা হিসাবে ১৫ ভাগের বেশি। আসনসংখ্যা কমানোর কারণ জানতে চাইলে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বলছেন, আবাসনব্যবস্থা, গ্রন্থাগার-সুবিধা, শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও পরিবহন যোগাযোগ থেকে শুরু করে সর্বত্র অতিরিক্ত শিক্ষার্থীর চাপ রয়েছে। গত ২০ বছরে অপরিকল্পিতভাবে অনেক বিভাগ ও ইনস্টিটিউট খোলার কারণে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘প্রয়োজনভিত্তিক শিক্ষা’কে গুরুত্ব দিয়ে আসন কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর ফলে বেকারত্বও কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রতিবছর হাজার হাজার ‘শিক্ষিত বেকার’ তৈরি হচ্ছে, ‘চাকরির বাজার’ যথেষ্ট প্রসারিত হয়নি, এসব বিবেচনায় আসন কমানো ঠিক হয়নি। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনার উদ্দেশ্য শিক্ষার্থীর চাকরি নিশ্চিত করা নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান কাজ-মৌলিক পাঠদানের মাধ্যমে গবেষণার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করা। নতুন নতুন গবেষণা সমাজ ও রাষ্ট্রকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। তাই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার সুযোগ বরং বাড়ানো দরকার। কেননা, অধিকসংখ্যক উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠী রাষ্ট্রের জন্য বোঝা নয়, সম্পদ হয়। প্রতিবছর এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ১২ থেকে ১৩ লাখ ছাত্রছাত্রী। তাদের মধ্যে শতকরা ৯০ থেকে ৯৫ ভাগ উত্তীর্ণ হচ্ছে। এদিকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আসন আছে ৫০ হাজারের মতো। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নূন্যতম যোগ্যতা নির্ধারণ করে দিতে হয়। তারপরও দেখা যায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি আসনের বিপরীতে পরীক্ষা দেন গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ জন। তবে এই এক বছরে এ ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো পরিবর্তন আসেনি। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক-অনাবাসিক দ্বৈত সুবিধা আছে, সেখানে হঠাৎ ভর্তি-ইচ্ছুক শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমানো কোনো ভালো সিদ্ধান্ত নয়। তা ছাড়া প্রতিটি ক্ষেত্রে সক্ষমতা ও ব্যবস্থাপনার সুষম সমন্বয় দরকার। নতুন এই পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কতটা স্বাভাবিকভাবে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেবে, শিক্ষার্থীরা কতটা এর সঙ্গে নিজেদের খাপ খাইয়ে নিতে পারবে? অভিভাবকরাই বা কতটা সাপোর্ট দিতে পারবেন? যেসব প্রতিষ্ঠান গত দুই বছর অনলাইনের সহযোগিতা নিয়ে এগিয়েছিল তারা এগিয়ে যাবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যেসব প্রতিষ্ঠান পিছিয়ে পড়েছে কিংবা একেবারেই কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি, তাদের জন্য সামনের দিনগুলোতে শিক্ষায় নিউ নরমাল লাইফ আদৌ নরমাল হবে কি না সন্দেহ আছে। তাই এখন থেকেই পিছিয়ে পড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীদের তুলে আনার ক্ষেত্রে করণীয় ঠিক করতে হবে। বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে।