২০১৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে মিয়ানমার সেনাদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার মুখে আট লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। পালিয়ে আসা ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ রোহিঙ্গার তালিকা বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে হস্তান্তর করে। ‘যাচাই-বাছাই’-এর পর তা থেকে ৬২ হাজার ২৮৫ ব্যক্তিকে ‘ক্লিয়ার’, অর্থাৎ মিয়ানমার থেকে আগত বলে নিশ্চিত করে মিয়ানমার। গত ছয় বছরে একজন রোহিঙ্গাও প্রত্যাবাসিত হয়নি। ২০১৮ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের পররাষ্ট্রসচিবদের মধ্যে বৈঠকে পরের মাসে সীমিতসংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে ফেরত নেওয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মিয়ানমারে বিরাজমান পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিতে এর বিরোধিতা করে জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের প্রধান মারজুকি দারুসমান তখনো রোহিঙ্গাবিরোধী গণহত্যা চলমান বলে মতপ্রকাশ করেন। তালিকাভুক্ত শরণার্থীদের আপত্তির মুখে এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এর প্রায় এক বছর পর ঢাকায় এক দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে আবার প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া শুরুর সিদ্ধান্ত হয়। আগেরবারের মতোই তালিকাভুক্ত রোহিঙ্গাদের অসম্মতির কারণে এ প্রয়াস সফল হয়নি। ফের শুরু হলো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে তামাশা। সর্বশেষ চীনের মধ্যস্থতায় কুনমিংয়ে অনুষ্ঠিত ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ বছরের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে পরীক্ষামূলক প্রকল্পের আওতায় মোট ৭ হাজার ১৭৬ রোহিঙ্গাকে রাখাইনে ফিরিয়ে নেওয়া হবে বলে যানা যায়। পাঁচ বছর আগে চীনের সর্বশেষ উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুটি অনেকটা ধামাচাপা পড়ে গিয়েছিল। অনেকে ধরেই নিয়েছিলেন যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে অগ্রগতি হবে না। সাম্প্রতিক সময়ে হঠাৎ করেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের বিষয়টি আবারো আলোচনায় এসেছে। বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমার খানিকটা নড়চড়ে বসেছে। এতদিন মিয়ানমার নানাভাবে রোহিঙ্গাদের অস্বীকার করছিল, সেই অস্বীকৃতি আর থাকবে না। রোহিঙ্গারা যে তাদের দায়, এটা তখন স্বীকৃত হয়ে যাবে। মিয়ানমার এমন একটা সময়ে প্রত্যাবাসনের এই প্রচেষ্টা শুরু করেছে, যার কিছুদিনের মধ্যে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে তাদের জবাব দিতে হবে। এখন আবার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে চীনের তরফ থেকে এই তৃতীয় দফার উদ্যোগ নেয়া হলো। প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা নিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন চীনের বিশেষ দূত। আমরা অন্তত মিয়ানমার সরকারের কাছ থেকে এ ব্যাপারে খুব দ্রুত ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রত্যাশা করতে পারি। আমরা আশা করি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াটির শুভযাত্রার প্রতি তাদের পূর্ণ সমর্থন প্রসারিত করবে। রোহিঙ্গারা স্বেচ্ছায় তাদের দেশে ফিরে যাবে এবং সম্মানের সঙ্গে তাদের ভিটায় বসবাস করবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা। বাস্তবিক কারণেই বাংলাদেশের পক্ষে রোহিঙ্গাদের ভার বহন করা সম্ভব নয়। তারপরেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের সম্পূর্ণ মানবিক কারণে আশ্রয় দিয়েছে। এর অর্থ এই নয় যে তারা এখানে অনাদিকাল পর্যন্ত থাকবে। বাংলাদেশ ছোট আয়তনের একটি দেশ, যার নিজের ১৭ কোটি মানুষ নিয়েই সমস্যার অন্ত নেই। আমাদের সীমাবদ্ধতাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনুধাবন করা উচিত।