দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিনিয়ত প্রাণ হারাচ্ছেন মানুষ। সড়ক দুর্ঘটনা দেশে একটি সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে নতুন বিপদ হয়ে দেখা দিয়েছে বেপরোয়া মোটরবাইক বা মোটরসাইকেল। সড়ক-মহাসড়কে সংঘটিত দুর্ঘটনাগুলোর একটি বড় অংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেল। সড়কে প্রায় ৩০ ভাগ দুর্ঘটনাই মোটরসাইকেল আরোহীর ঘন ঘন লেন পরিবর্তন, নিয়ম না জানা বা জানলে না মানা, যানজট এড়িয়ে তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছার কারণে ঘটছে। সস্প্রতি এক জরিপে দেখা যায়, গত সেপ্টেম্বর মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ৪১৭ জন, যাদের মধ্যে ১৭২ জন প্রাণ হারিয়েছেন মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়। এটি মোট মৃত্যুর প্রায় ৪৩ শতাংশ। গত তিন বছরে সড়কে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মারা গেছে প্রায় ৫ হাজারের বেশি মানুষ। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের সংখ্যা ৪০ লাখ ৬৮ হাজার ৮১৯টি। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় নিবন্ধন হয়েছে ১০ লাখ ৩০ হাজার ৬৪৭টি। এতে করে বুঝা যায় যে দেশে মোটরসাইকেলের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে। এর পাশাপাশি মোবাইল ফোন অ্যাপস-ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে ঢাকায় পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মোটরসাইকেলের সংখ্যা। কেউ আসছে গ্রাম থেকে, কেউ বা আবার করোনায় চাকরি হারিয়ে, আবার অনেকে ব্যবসায় লোকসান দিয়ে আয়ের উৎস হিসেবে বেছে নিয়েছে এই পেশা। এই সুযোগে অদক্ষ ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা চালকরা বেপরোয়া ভাবে সড়কে চলছে ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা। মোটরসাইকেলের বেপরোয়া গতি, ওভারটেক করা ছাড়াও বার বার লেন পরিবর্তনসহ মুঠোফোনে কথা বলা, এমনকি কোনভাবেই ট্রাফিক বিধি নিষেধকে তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছামাফিক সড়কে বাইক চালানোয় ঘটছে দুর্ঘটনা। তাছাড়া নিম্নমানের হেলমেট যা অত্যন্ত জরুরী সেখানেও রয়েছে প্রচুর ত্রুটি, বিচ্যুতি। মোটরসাইকেলের দুরন্ত গতিতে চলা রাস্তায় পথচারীরাও নিরাপদে থাকে না। দেখা যায় অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় তা উঠে পড়ে ফুটপাতে, এতে করে মারাত্মক ভাবে আহত ও নিহত হয়ে থাকে নিরীহ পথচারীরা। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা এবং হতাহতের ঘটনা বৃদ্ধির বহুবিধ কারণ রয়েছে। দেশে বেশীরভাগ কিশোরদের এখন মোটরসাইকেলের প্রতি দুর্নিবার আকর্ষণ। তাদের শখ-আহ্লাদ মেটাতে অনেক বাবা-মা বয়সের আগেই সন্তানের হাতে তুলে দিচ্ছেন মোটরবাইকের চাবি। এসব তরুণদের বেশীরভাগের মধ্যেই রয়েছে জ্ঞানের অভাব এবং ট্রাফিক আইন না মানার প্রবণতা। ফলে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। আবার যথাযথ হেলমেট না পরা মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যুর আরো একটি কারণ। এই মৃত্যুর কমাতে এখনি সরকারকে দীর্ঘমেয়াদি পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ বৃদ্ধি করতে হবে, ট্রাফিক আইনের বাধাহীন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সড়কে কঠোর নিয়মকানুন এবং তা মেনে চলার বাধ্যবাধকতা আরোপ করে সীমিত আকারে মোটরসাইকেল চলাচলের অনুমতি দিতে হবে। মোটরসাইকেলের জন্য পৃথক লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের হেলমেট থাকে, তারা কিছুটা হলেও কম বিপদগ্রস্ত হন তাই হেলমেট পড়া বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনেক সময়ই দেখা যায়, যারা অ্যাপস-ভিত্তিক রাইড শেয়ারিং করছে তাদের নির্দিষ্টভাবে দাঁড়ানোর কোনো জায়গা থাকেনা। এদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এসবের পাশাপাশি অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে, আবেগের বশবর্তী হয়ে কিশোর সন্তানের হাতে মোটরসাইকেলের চাবি চুলে দেওয়ার আগে দুইবার ভাবতে হবে। সর্বোপরি আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলা এ দুর্ঘটনা কমাতে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।