মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ৩ এপ্রিল প্রাণঘাতি করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে ৩১ দফা নির্দেশনা প্রদান করেছেন। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে গণমাধ্যম কর্মীদের যথাযথ দায়িত্ব পালন এবং গুজব ছড়ানো প্রতিরোধসহ জনগণ এবং প্রশাসনের জন্য অবশ্য পালনীয় হিসেবে ওই ৩১ দফা নির্দেশনার অবতারণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ তথ্য গণমাধ্যমে নিশ্চিত করেছেন।
করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৩১ দফা নির্দেশনাগুলো পাঠকদের উদ্দেশে তুলে ধরা হলো-
১. করোনা ভাইরাস সম্পর্কে চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এ ভাইরাস সম্পর্কিত সচেতনতা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। ২. লুকোচুরির দরকার নেই, করোনা ভাইরাসের উপসর্গ দেখা দিলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন। ৩. ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) সাধারণভাবে সকলের পরার দরকার নেই। চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য পিপিই নিশ্চিত করতে হবে। এই রোগ চিকিৎসায় ব্যবহৃত পিপিই, মাস্কসহ সকল চিকিৎসা সরঞ্জাম জীবাণুমুক্ত রাখা এবং বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। ৪. কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ঠ সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে। ৫. যারা হোম কোয়ারেন্টাইনে বা আইসোলেশনে আছেন, তাদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে। ৬. নিয়মিত হাত ধোয়া, মাস্ক ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। ৭. নদীবেস্টিত জেলাসমূহে নৌ-এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে হবে। ৮. অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের যথাযথ স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং চিকিৎসাসেবা অব্যাহত রাখতে হবে। ৯. পরিচ্ছন্নতা নিশ্চত করা। সারাদেশের সকল সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম আরও জোরদার করতে হবে। ১০. আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে দৃষ্টি দিতে হবে। জাতীয় এ দুর্যোগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগসহ সকল সরকারি কর্মকর্তাগণ যথাযথ ও সুষ্ঠু সমন্বয়ের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন- এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। ১১. এাণ কাজে কোনো ধরনের দুর্নীতি সহ্য করা হবে না। ১২. দিনমজুর, শ্রমিক, কৃষক যেনো অভুক্ত না থাকে। তাদের সাহায্য করতে হবে। খেটে খাওয়া দরিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য অতিরিক্ত তালিকা তৈরি করতে হবে। ১৩. সোশ্যাল সেফটিনেট কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। ১৪. অর্থনৈতিক কর্মকা- যেনো স্থবির না হয়, সেবিষয়ে যথাযথ নজর দিতে হবে। ১৫. খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে, অধিক প্রকার ফসল উৎপাদন করতে হবে। খাদ্য নিরাপত্তার জন্য যা যা করা দরকার করতে হবে। কোনো জমি যেনো পতিত না থাকে। ১৬. সরবরাহ ব্যবস্থা বজায় রাখতে হবে। যাতে বাজার চালু থাকে। ১৭. সাধারণ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ১৮. জনস্বার্থে বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠান বন্ধ রাখতে হবে যাতে জনসমাগম না হয়। ঘরে বসে ডিজিটাল পদ্ধতিতে নববর্ষ উদযাপন করতে হবে। ১৯. স্থানীয় জনপ্রতিনিধিগণ, রাজনৈতিক নেতৃৃবৃন্দ, সমাজের সকল স্তরের জনগণকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রশাসন সকলকে নিয়ে কাজ করবে। ২০. সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানসমূহ জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সঙ্গে সমন্বয় করে ত্রাণ ও স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। ২১. জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা প্রশাসন ওয়ার্ড ভিত্তিক তালিকা প্রণয়ন করে দুঃস্থদের মধ্যে খাবার বিতরণ করবেন। ২২. সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী যেমন: কৃষি শ্রমিক, দিনমজুর, রিকশা/ভ্যান চালক, পরিবহন শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, পথশিশু, স্বামী পরিত্যক্তা/বিধবা নারী এবং হিজড়া সম্প্রদায়ের প্রতি বিশেষ নজর রাখাসহ ত্রাণ সহায়তা প্রদান নিশ্চিত করতে হবে। ২৩. প্রবীণ নাগরিক ও শিশুদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। ২৪. দুর্যোগ বিষয়ক স্থায়ী আদেশাবলী (এসওডি) যথাযথভাবে প্রতিপালনের জন্য সকল সরকারি কর্মচারী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। ২৫. নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের উৎপাদন, সরবরাহ ও নিয়মিত বাজারজাতকরণ প্রক্রিয়া মনিটরিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ২৬. আতঙ্কিত হয়ে অতিরিক্ত পণ্য ক্রয় করবেন না। ২৭. কৃষকগণ নিয়মিত চাষাবাদ চালিয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকবে। ২৮. সকল শিল্প মালিক, ব্যবসায়ী ও ব্যক্তি পর্যায়ে নিজ নিজ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং বাড়ি-ঘর পরিষ্কার রাখবেন। ২৯. শিল্প মালিকগণ শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজেদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে উৎপাদন অব্যাহত রাখবেন। ৩০. গণমাধ্যম কর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। ৩১. গুজব রটানো বন্ধ করতে হবে। ডিজিটাল প্লাটফর্মে নানা গুজব রটানো হচ্ছে। গুজবে কান দিবেন না এবং গুজবে বিচলিত হবেন না।
উল্লেখ্য, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যারা সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছে এমন ব্যক্তিদের সরকারের পক্ষ থেকে নানা ধরনের প্রণোদনা দিচ্ছে সরকার। প্রধানমন্ত্রীর ৪ নং দফায় কোভিড-১৯ রোগের চিকিৎসায় নিয়োজিত সকল চিকিৎসক, নার্স, ল্যাব টেকনিশিয়ান, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, এ্যাম্বুলেন্স চালকসহ সংশ্লিষ্ঠ সকলের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বিশেষ অগ্রাধিকার প্রদানের কথা উল্লেখ থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়ে কিছুই বলা নেই। ২৭ নং দফায় কৃষকদের চাষাবাদে সরকারি প্রণোদনা অব্যাহত থাকার কথা উল্লেখ করলেও গণমাধ্যকর্মীদের প্রণোদনা বিষয়ে বলা হয়নি। ৩০ নং দফায় ‘গণমাধ্যম কর্মীরা জনসচেতনতা সৃষ্টিতে যথাযথ ভূমিকা পালন করে চলেছেন’ এ কথা স্বীকার করলেও আবার বলা হয়েছে ‘এক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।’
এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী ‘গুজব ও অসত্য তথ্য যাতে বিভ্রান্তি ছড়াতে না পারে’ বলতে কী তিনি বোঝাতে চেয়েছেন? নাকি তিনি বলতে চেয়েছেন, গণমাধ্যমে ‘গুজব ও অসত্য তথ্য ছড়াতে পারে’! সেকারণেই ‘সতর্ক’ শব্দটি ব্যবহার করে জনগণকে ‘সজাগ’ থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি? আবার হতে পারে প্রধানমন্ত্রী অন্য কিছুও বোঝাতে চেয়েছেন। যা আমাদের মতো তেল না মারা সাংবাদিকদের বুঝতে যোজন যোজন বাকি?
গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, গত ১৯ এপ্রিল জেলা-উপজেলায় কর্মরত সাংবাদিকদের তালিকা প্রণয়ন করে বিশেষ প্রণোদনা দিতে দেশের সব জেলা প্রশাসকদের (ডিসি) কাছে ইমেইলে চিঠি দিয়েছেন বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সচিব মো. শাহ আলম। সাংবাদিকদের বিষয়ে চিঠিতে ডিসিদের বলা হয়, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সাংবাদিক ও সংবাদ সংশ্লিষ্ট কর্মীরা করোনা ভাইরাসের ঝুঁকি নিয়ে জরুরি তথ্য জানানোর জন্য জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে কাজ করছেন। তাই তাদের জন্যও প্রণোদনা প্রয়োজন। এমতাবস্থায় আপনার জেলায় প্রেসক্লাব ও সাংবাদিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে সাংবাদিক ও সংশ্লিষ্টদের তালিকাভুক্ত করে প্রণোদনার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো। বাস্তবতা হলো এখনো সাংবাদিকদের প্রণোদনার বিষয়ে ডিসিদের পক্ষে কোনো উদ্যোগ গ্রহণ পরীক্ষিত হচ্ছে না।
উল্লেখ্য, পুলিশ, স্বাস্থ্যকমী থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি কর্মচারী তথা গ্রাম পুলিশ পর্যন্ত প্রণোদনার দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার। প্রণোদনার বাইরে রাখা হয়েছে চরম ঝুঁকিপূর্ন পেশায় নিয়োজিত সাংবাদিকদের! আমরা বলতে চাই, করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় যারা সার্বক্ষণিক মাঠে রয়েছে, তাদের মধ্যে সাংবাদিকরা অন্যতম। সাংবাদিকরা করোনা মোকাবিলায় সম্মুখযোদ্ধা। ইতোমধ্যে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। তিনজন মারাও গেছেন। প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে এখনো সাংবাদিকদের জন্য কোনো প্রণোদনার উদ্যোগ নেয়ার বিষয়ে জানা যায়নি। বিপরীতি সরকারের কাছে বছরের পর বছর বিভিন্ন গণমাধ্যমের কোটি কোটি টাকা বকেয়া বিজ্ঞাপন বিল রয়েছে। ফলশ্রুতিতে সাংবাদিকদের বেতন-ভাতাও মাসের পর মাস বকেয়া রাখতে হচ্ছে গণমাধ্যম মালিকদের। মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থা আরো করুণ। তারা তো নিজের খেয়ে বন্য হাতি তাড়ান। সংসার না বোঝে সত্য লিখে হুমকি ভায়া ডিজিটালের ডা-া বেরি পড়ে জেলহাজত খোঁজেন। আজীবন বেকারের অভিশপ্ত তকমা নেন। এতসব পরেও সমাজ তথা সরকার কিঞ্জিত পরিমাণ মূল্যায়ন করতে চান না সাংবাদিকদের। করোনা পরিস্তিতিতে দৈনিক আমাদের নতুন সময় সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান একাধিকবার ফেইসবুক লাইভে এসে বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধে সকরুণ অনুরোধ করলেও সরকারের পক্ষে কোনো ধরনের গরজ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। গণমাধ্যমকর্মীদের প্রতি কোনো ধরনের বৈরিআচরণ মোটেও কাম্য নয়। আমরা মনে করি, করোনায় কোনো করুণা নয়, বরং ন্যায অধিকার। করোনা পরিস্থিতিতে সাংবাদিকদের প্রণোদনা এবং বিজ্ঞাপনের বকেয়া বিল পরিশোধে অতিদ্রত পদক্ষেপ নেয়াই হবে সরকারের অত্যাবশক করণীয় ও পালনীয়।
(লেখক : এম. কে. দোলন বিশ্বাস, দৈনিক সংবাদের সাবেক সহ-সম্পাদক)