রাজবাড়ীর স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে করোনা উপসর্গ সন্দেহে নমুনা সংগ্রহ করে ঢাকায় পাঠালেও তার ফলাফল পেতে দেরি হচ্ছে। নমুনা দেয়া ব্যক্তিরা যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এতে করে আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা অনেকেই নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছে। তবে নমুনা পরীক্ষার ফলাফল প্রতিদিন হাতে পাওয়া গেলে সংক্রমণ অনেক কমে যেতো বলে মনে করছেন অনেকেই।
শনিবার (২০ জুন) সিভিল সার্জন দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী জেলায় এ পর্যন্ত ৩ হাজার ২ শ’র বেশি ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। এর মধ্যে ফলাফল এসেছে ২ হাজার ৮ শ জনের মতো। এতে ১৬৫ জনের দেহে করোনা সনাক্ত হয়েছে। এদের মধ্যে সুস্থ হয়েছেন ৫৩ জন, মারা গেছে ২ জন। বর্তমানে ৩৪ জন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, বাকীরা সবাই বাড়ীতে আইসোলেশনে আছেন। এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে রাজবাড়ীতে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয় জেলায়।
রাজবাড়ী সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ফেসবুক আইডিতে প্রকাশিত গত কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষনে দেখা যায়, জুন মাসের ১৩ তারিখের নমুনার ফলাফল এসেছে ২০ জুন, সেখানে পজিটিভ ১৩ জন, ১২ তারিখের নমুনার ফলাফল এসেছে ১৮ জুন, সেখানে পজিটিভ ১২ জন; ১১ তারিখের ফলাফল এসেছে ১৭ জুন, পজিটিভ ৮ জন; ১০ তারিখের নমুনার ফলাফল এসেছে ১৬ জুন, পজিটিভ ১০ জন; জুন মাসের ৯ তারিখের নমুনার ফলাফল এসেছে ১৫ জুন, পজিটিভ ৭ জন; ৮ তারিখের নমুনার ফলাফল এসেছে ১৪ জুন, পজিটিভ ২০ জন। এভাবে প্রতিটি নমুনার ফলাফল পেতে সময় লাগছে গড়ে ৭ দিন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এর বেশি সময়ও লাগছে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক (৩০) বলেন, ‘আমি চলতি মাসের ৩ তারিখেও কর্মস্থলে ছিলাম, ৪ তারিখে নমুনা দেই, আমার রিপোর্ট আসে ৯ তারিখে। পরবর্তী নমুনা দেই ১১ তারিখে, সেটার ফলাফল আসে ১৭ তারিখে, আবার ১৭ তারিখে নমুনা দেই, সেটার ফলাফল পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’ তিনি মনে করেন এই দীর্ঘসূত্রিতায় করোনা সংক্রমন বৃদ্ধির অন্যতম কারন। ‘আমি তো সুস্থ আছি, আমি সচেতন বিধায় ফলাফলের অপেক্ষায় আছি কিন্তু অধিকাংশ মানুষই সেটা মানছে না, নমুনা দিয়েও তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অবশ্য আমার কর্মস্থলের একজন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানতে পেরেছি।’
নাম প্রকাশে একাধিক ব্যক্তি জানান, আমাদের এলাকায় একাধিক ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত পরবর্তী প্রশাসনের পক্ষ থেকে যখন বাড়ী লকডাউন করা হয়, তখনি বুঝতে পারি তারা করোনায় আক্রান্ত। তবে তাঁর আগে ওই ব্যক্তিগুলো বাইরে চলাফেরা করেছেন, যার যে পেশা সেই পেশায় তাঁরা ব্যস্ত ছিলেন।
নারুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আ. সালাম বলেন, যারা নমুনা দিচ্ছেন তারা তো সবাই বাড়ীতে বসে নেই। এমনকি গত পরশু দিন যিনি আমার ইউনিয়নে করোনা আক্রান্ত বলে জেনেছি, সেও সর্বশেষ বাইরে ঘুরেছেন, কারণ তাঁর কোন উপসর্গ ছিলো না। নমুনার ফলাফল পাওয়ায় বিলম্ব হওয়ায় করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়ছে। এছাড়াও সবাই স্বাস্থ্য বিধি মানছে না। প্রতিটি মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি মানাসহ নমুনা দেয়া ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে পারলে অনেকটা ঝুঁকি কমানো সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
রাজবাড়ী সচেতন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি মো. নুরুজ্জামান বলেন, নুমনা পরীক্ষার ফলাফল প্রতিদিন হাতে পেলে খুব ভালো হয়। একারনে প্রতিটি জেলায় ল্যাব স্থাপন করা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের সরকারের সামর্থ্যও দেখতে হবে। তবে আমাদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যাওয়া যাবে না। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলতে হবে। সবাইকে ফুসফুসের ব্যায়াম করতে হবে।
বালিয়াকান্দি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. শাফিন জব্বার বলেন, করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলার কোন বিকল্প নেই। প্রতিটি মানুষকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা উচিত। নমুনা দেয়া ব্যক্তিকে তাৎক্ষনিক ভাবে অনুরোধসহ নির্দেশনা দেয়া হচ্ছে ঘরে থাকতে। স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রশাসন যথেষ্ঠ পরিশ্রম করছে মানুষকে সচেতন করতে। আসলে আমরা যদি সচেতন না হই তাহলে করোনাকাল দীর্ঘ হবে আমাদের জন্য।
বালিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ. কে. এম. হেদায়েতুল ইসলামের মতে, ‘ বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় করোনা উপসর্গ নিয়ে নমুনা দেয়া ব্যক্তিকে হোম কেয়ারেন্টাইন নিশ্চিতের কোন বিকল্প নেই। কারণ নমুনা দেয়া হতে ফলাফল পাওয়া পর্যন্ত সময়ে তিনি বিভিন্ন জনের সংস্পর্শে আসেন। সব থেকে বড় সমস্যা হচ্ছে উপসর্গবিহীন ব্যক্তিদের আক্রান্ত হওয়া।
হেদায়েতুল ইসলাম বলেন, বালিয়াকান্দিতে এরইমধ্যে একাধিক ব্যক্তি করোনা আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে কোন ধরনের উপসর্গ ছিলো না। উপসর্গসহ ব্যক্তির নমুনা দেয়ার পর হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত না করতে পারলে করোনার সামাজিক বিস্তার ঠেকানো সম্ভব নয়। এরইমধ্যে বালিয়াকান্দির কয়েকটি গ্রামে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্বাস্থ্য বিধি মেনে বাহিরে চলাচলে ও বাজার পরিচালনায় কঠোর অবস্থা নেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, নমুনা দেয়া ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা কঠিন চ্যালেঞ্জ, তবে বালিয়াকান্দি প্রশাসন সেটা নিশ্চিত করতে সমাজের সকলকে নিয়ে চেষ্টা অব্যাহত রাখবে।
রাজবাড়ী সিভিল সার্জন মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘ফলাফল হাতে পাওয়ার বিলম্বে সংক্রমন বৃদ্ধির ঝুঁকিটা খুব বেশি, নমুনা দেয়া ব্যক্তিটি যত্রতত্র ঘুড়ে বেড়াচ্ছেন বলে তথ্য রয়েছে। নমুনা সংগ্রহের সময় তাকে ঘরে থাকতে বলা হচ্ছে। মূলত যিনি নমুনা দিচ্ছেন তাঁর উচিত ঘরে থাকা। নমুনা সংগ্রহ থেকে আইসিডিডিআরবি থেকে ফলাফল পেতে গড়ে ৭-৯ দিন সময় লাগছে। ফলাফল পরবর্তী পজিটিভ আসা ব্যক্তি পূর্বে যত্রতত্র ঘোড়াঘুড়ি করায় সংক্রমন বৃদ্ধি পাচ্ছে। জেলায় ল্যাব স্থাপনের সুযোগ নেই। তাই নমুনা সংগ্রহ করা ব্যক্তিকে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে। কমিউনিটিতে সংক্রমন ঠেকাতে স্থানীয় প্রশাসনের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে’ বলেও তিনি জানান।
রাজবাড়ী জেলা প্রশাসক দিলসাদ বেগম বলেন, বর্তমানে প্রেক্ষাপটে জেলায় পিসিআর ল্যাব স্থাপনের কোন বিকল্প নেই। কমিউনিটি সংক্রমন রোধে নমুনা দেয়া ব্যক্তিকে ঘরে থাকা উচিত। দ্রুত নমুনার ফলাফল দিলে সংক্রমন ঝুঁকি অনেকটাই কমে যেত। যেহেতু আমাদের পিসিআর ল্যাব নেই সেহেতু বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসনের সাথে আলোচনা করে স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে তালিকাসংগ্রহ পূর্বক তাদেরকে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা হবে।