যেখানে প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আবাসিক সংকট প্রকট, সেখানে ছাত্রত্ব শেষ হওয়ার পরও একশ্রেণির তরুণ বছরের পর বছর হলে থাকেন কীভাবে? যে আবাসিক হলে শিক্ষকদের কক্ষ বরাদ্দের দায়িত্ব পুরোপুরি হল প্রশাসনের হলেও ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনটি হস্তক্ষেপ করে আসছে সেখানে। বিশেষ করে বিভিন্ন হলের গেস্টরুমগুলো পুরোপুরি তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। যদিও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে বহিরাগতদের অবস্থানের বিরুদ্ধে অনেক আন্দোলন হয়েছে; সংঘাতের ঘটনা ঘটেছে কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সেই দলের ভ্রাতৃপ্রতিম ছাত্রসংগঠনই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এ ধারা চলে আসছে নব্বই-পরবর্তী সব ‘গণতান্ত্রিক’ শাসনামলে। পরিস্থিতি এতটাই অসহনীয় যে জাহাঙ্গীরনগর ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ঘটনা ভিন্ন হলেও চরিত্র অনেকটা অভিন্ন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী হল থেকে অছাত্রদের বহিষ্কারের দাবিতে অনশন ও অবস্থান ধর্মঘট করছেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বিবদমান দুই গ্রুপ সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, যাঁরা শিক্ষালয়ে অস্ত্রের মহড়া দিয়েছেন। দুই ঘটনার উৎস ক্ষমতার রাজনীতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের এসব কক্ষ দীর্ঘদিন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা দখল করে ছিলেন; যাঁদের অনেকের ছাত্রত্ব অনেক আগেই শেষ হয়েছে। আবাসিক হলে এই জবরদখল কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েই ঘটেছে, তা নয়। প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থীরা এই অনাচারের শিকার। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেমন আবাসিক শিক্ষার্থী বেশি, সমস্যাও প্রকট। প্রায় সব হলে তাঁরা ‘গণরুম কালচার’ চালু করেছেন। এসব গণরুমের বাসিন্দাদের ছাত্রলীগের মিছিল-সমাবেশে উপস্থিত থাকা ও তালিম নেওয়া বাধ্যতামূলক। যাঁরাই তাদেও হুকুম মানেন না, তাঁদের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। বিশেষ সূত্রে জানাযায়, পাঁচ বছর ধরে হল প্রশাসন কক্ষ বরাদ্দ দেওয়া বন্ধ রেখেছে। ছাত্রলীগই বরাদ্দের কাজটি করে থাকে। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে হল প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে মাত্র ৪.৪১ শতাংশ আসন। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে প্রায় ৭৯ শতাংশ। তবে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যতিক্রমীভাবে অল্প কিছু আসন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট, ছাত্র ফেডারেশন ও তাবলিগও নিয়ন্ত্রণ করে। এসব ঘটনা থেকে এখন এটাই প্রমানিত হয়, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনের কোনো কর্তৃত্বই নেই। এমনকি আবাসিক হলে সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনের জবরদখলের কারণে অনেক অঘটনও ঘটেছে, অনেক শিক্ষার্থীর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ও হল প্রশাসন এই জবরদস্তির বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা সবকিছু ঠিক আছে বলে দায় এড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এই অবিমৃশ্যকারিতার জন্য আমাদের শিক্ষার মান ক্রমেই নিচে নেমে যাচ্ছে। তাই দেশের শিক্ষার অবনতি ঠেকানোর পথ খুঁজে বের কওে, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোয় প্রশাসনের কর্তৃত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে এবং ছাত্রলীগের দৌরাত্ম্য বন্ধের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মেধার ভিত্তিতে হলের আসন বরাদ্দ পাবার সু-ব্যবস্থা করতে হবে। জ্ঞান অন্বেষণ ও সৃষ্টির জায়গা হলো বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে কোনো জবরদস্তি ও অস্ত্রবাজি চলতে পারে না।