বর্তমানে ছয় লাখের মতো রোহিঙ্গা মিয়ানমারে বাস করছে (এর মধ্যে আবার দেড় লাখের মতো রোহিঙ্গা অভ্যন্তরীণ-ভাবেই বাস্তুচ্যুত) এবং মিয়ানমার সরকারের কোনো ইচ্ছে নেই এ সংখ্যা বাড়ানোর। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, সংখ্যা তো প্রাকৃতিকভাবেও বাড়তে পারে; তখন সরকার কী করবে? এ ক্ষেত্রে আগে থেকে কিছু বলা সহজ নয়। সামরিক সরকার হয়তো আবার দমনের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে সেটা নিয়ন্ত্রণের প্রচেষ্টা চালাবে (যেমন, একাধিক সন্তানের জন্মদান নিয়ন্ত্রণ)। মিয়ানমার সরকার সহসাই যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের দিকে যাবে না, সে ব্যাপারে মোটামুটি নিশ্চিত করে বলা যায়। বাংলাদেশ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন দেশে তদবির করেছে, যাতে করে এ সমস্যার শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায়, যার মধ্যে প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমারের বন্ধুরাষ্ট্র চীন রয়েছে। কিন্তু কোনো দেশই সেভাবে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়ায়নি। এর অন্যতম কারণ হলো, বাংলাদেশের ভূকৌশলগত অবস্থান এবং মিয়ানমারে চীন ও ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থ। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের স্বীকৃতি ও নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন এবং গণহত্যার বিচারের প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্র দেশগুলোর রাজনৈতিক ভূমিকা যেমন জোরালো, তাদের আর্থিক সহায়তাও প্রায় একই রকম। বিপরীতে মিয়ানমারের প্রতি নমনীয় রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া দুই শক্তিধর রাষ্ট্র চীন ও রাশিয়া এবং প্রতিবেশী ভারত বিপন্ন রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তায় অর্থ জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে একেবারেই নগণ্য বা নামমাত্র ভূমিকা রাখছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বছরওয়ারি হিসাব জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয় দপ্তর প্রতিবছর চাহিদা ঠিক করে যে পরিমাণ সহায়তার আহ্বান জানিয়েছে এবং কারা কী দিয়েছে, তার বিশদ হিসাব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে। এতে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সর্বোচ্চ সহায়তাদানকারীর অবস্থান ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের সাথে যেসব দেশ সহযোগীতার হাত বাড়িয়েছিল ও সহানুভূতি দেখিয়েছিল বর্তমানে তা অনেকটাই কমে গিয়েছে। তাই সরকারকে এখন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনে বিষয়ে জোর দিতে হবে। মিয়ানমার এমন একটি রাষ্ট্র, যার সঙ্গে কোনো ধরনের কূটনৈতিক আলোচনা কখনোই সহজ নয়। মিয়ানমার সবসময়ই সামরিক বাহিনী কর্তৃক প্রভাবিত একটি রাষ্ট্র। বর্তমান পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পুনর্মূল্যায়ন করে অবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নীতি প্রণয়ন করতে হবে। মিয়ানমারের সরকারবিরোধী পক্ষ এনইউজির (ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট) সঙ্গেও দরকষাকষির সক্ষমতা বজায় রাখতে হবে। বাংলাদেশকে আরও একটি বিষয় লক্ষ রাখতে হবে-মিয়ানমারের সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার হলো চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর ও ইন্দোনেশিয়া। রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন কার্যকর করতে এসব ব্যবসায়িক অংশীদার দেশের সঙ্গে জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে, যাতে করে তারা মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ করে।